অবশেষে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে মুখ খুললেন ড. ইউনূস

October 1, 2024 | জাতীয়

নির্বাচনের সময় নিয়ে ড. ইউনূস
আমাদের মুখ থেকে যখন শুনবেন, সেটাই হবে তারিখ
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণ শেষে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ভয়েস অব আমেরিকা বাংলাকে সাক্ষাৎকার দেন। ভয়েস অব আমেরিকার জন্য সাক্ষাৎকারটি নেন আনিস আহমেদ। সেই সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।

প্রশ্ন: গত ৮ আগস্ট আপনার দায়িত্ব গ্রহণের মাস দেড়েক পর এসে আমরা লক্ষ করছি যে সেনাবাহিনীর কমিশনড অফিসারদের ম্যাজিস্ট্রেসি (বিচারিক) ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এটার প্রযোজনীয়তা কেন দেখা দিল?
ড. ইউনূস: দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার করার জন্য আমরা চেষ্টা করছিলাম, পুলিশকে দিয়ে করার জন্য। এটাই নিয়ম। কিন্তু পুলিশের মনোবল হারিয়ে গেছে। কারণটা হলো, মানুষের সামনে গেলে তাদের কটু কথা শুনতে হয়। মাত্র কয়েক দিন আগে তারা ছাত্রদের মেরেছে। তাই তারা মানুষের থেকে দূরে দূরে থাকছে। মানুষের সঙ্গে তারা মিশতে চাইছে না। কাজেই আমাদের শান্তিশৃঙ্খলার যে শক্তি, সেটা তাদের মনোবল হারানোয় ক্ষয়ে গেল। আমরা যেটা করলাম যে পুলিশের সবাই তো আর অন্যায় করেনি। যারা অন্যায় করেছে, তারা চিহ্নিত করব, তাদের শাস্তি হবে। বাকিরা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু এ প্রক্রিয়া তো একটা লম্বা প্রক্রিয়া। এটা তো হঠাৎ করে হচ্ছে না। ইতিমধ্যে কিন্তু শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হচ্ছে। নানা রকমের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে, সমাবেশ হচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের পোশাকশিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের সন্ত্রাস দেখা গেল। সেগুলো নিয়ে মনে করলাম যে এভাবে চলতে দিলে তো এগুলো বাড়তে আরম্ভ করবে। তখন প্রশ্ন উঠল সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার জন্য। ওদের অনুরোধ করলাম। ওরা রাজি হলো। তারা বলছে, আমরা তো আছিই। কিন্তু আমাদের তো কেউ পরোয়া করছে না। কারণ, আমাদের ক্ষমতা নেই। আমাদের একটা ক্ষমতা থাকলে তখন হয়তো আমাদের গণ্য করতে পারে। তখন আমরা সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিলাম।

প্রশ্ন: তাহলে আশা করছেন যে আগামী দুই মাসে পুলিশের যে সেবাটা জনগণের জন্য, সেটা ফিরে আসবে?
ড. ইউনূস: আশা করি এ সময়টার মধ্যে তারা পারবে। তারাও দেখছে যে তারা দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। সেই দায়িত্ব সেনাবাহিনী পালন করছে। এটা তাদের জন্যও খুব সুখকর কোনো বিষয় না। যে তাদের দায়িত্ব অন্যজন পালন করছে। মাঝখানে আনসার বাহিনীকে দিয়েও করা হয়েছিল। সেটাতেও কোনো কাজ হয়নি। কাজেই এভাবেই সমাধান করার চেষ্টা করছি।

প্রশ্ন: আমরা জানি যে বাংলাদেশের এই সাম্প্রতিক গণ–অভ্যুত্থানে নেতৃত্বে ছিলেন শিক্ষার্থীরা। আপনার সরকারেও শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে শিক্ষার্থীরা দেশের নানা ক্ষেত্রে, নানা প্রতিষ্ঠানে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। তো, শিক্ষার্থীরাই কী এখন দেশ পরিচালনা করছেন? কতটা ভূমিকা পালন করছেন?
ড. ইউনূস: করা তো উচিত। তরুণদের হাতেই তো ক্ষমতা যাওয়া উচিত। বুড়োদের তো কোনো কাজ নেই। বুড়োরা তো সব ভুল করে গেছেন এ পর্যন্ত। কাজেই চেষ্টা হোক যে তরুণেরা এগিয়ে আসুক। তারা দায়িত্ব নিক। তরুণরাও ভুলভ্রান্তি করবে। ভুলভ্রান্তি সংশোধন করবে নিজেদের। তাদের নেতৃত্বে তো এত বড় একটা কাণ্ড ঘটে গেল। কাজেই তাদের অবিশ্বাস করার তো কোনো কারণ আমি দেখছি না।

প্রশ্ন: তাহলে কি বলা যাবে শিক্ষার্থীরাই দেশ চালাচ্ছে?
ড. ইউনূস: চালানো উচিত বলছি। চালাচ্ছে এ কথা বলছি না। চালানো উচিত। তরুণদের হাতে ছেড়ে দেওয়া, এটা আমি সব সময়ই বলে এসেছি। এ দায়িত্ব পালন করার আগে থেকেই বলছি। কারণ, তরুণেরাই নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরা রচনা করবে। আমরা তাদের হয়ে যেটা রচনা করব, সেটা ঠিক হবে না। তাই আমি আবারও মনে করি, শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো বিশ্বে তরুণদের হাতে দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া ভালো।

প্রশ্ন: অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ সম্পর্কে আমরা আপনার সরকারের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত পরিষ্কারভাবে কিছু শুনিনি। আপনি জাতির উদ্দেশ্যে দুটি ভাষণ দিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও জানতে পারিনি। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন যে আগামী ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। তাহলে কি ধরে নেব যে আপনার অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ হচ্ছে আগামী ১৮ মাস পর্যন্ত?
ড. ইউনূস: আপনি ইচ্ছে করলে সেটা ধরে নিতে পারেন। কিন্তু সরকারের মতামত তো সেটা নয়। সরকার তো কোনো মত দেয়নি এ পর্যন্ত। কাজেই সরকার কখন মেয়াদ ঠিক করবে, সেটা সরকারকেই বলতে হবে। সরকার না বলা পর্যন্ত তো সেটা মেয়াদ হচ্ছে না।

প্রশ্ন: সরকার বলতে তো আপনাদেরই….
ড. ইউনূস: হ্যাঁ, আমাদেরই বলতে হবে। আমাদের মুখ থেকে যখন শুনবেন, সেটাই হবে তারিখ।

প্রশ্ন: তাহলে উপদেষ্টা পরিষদ এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি?
ড. ইউনূস: আমরা আলোচনা করেছি। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

প্রশ্ন: ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে আপনার সরকারের পরিকল্পনা কী?
ড. ইউনূস: আমরা পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি, আমরা সুসম্পর্ক চাই। এটা ভারতেরও দরকার। আমাদেরও দরকার। কারণ, আমরা দুই প্রতিবেশী। প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্ক ভালো না হলে সেটা কোনো জাতির জন্য মঙ্গলজনক হয় না। তাদের জন্যও মঙ্গলজনক না। আমাদের জন্যও না। আমাদের দুই দেশের স্বার্থ হলো অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আর মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলা। মাঝেমধ্যে প্রশ্ন এসে যায়, সম্পর্কে চিড় ধরে। যেমন সীমান্তে গুলি করল, বাচ্চা মেয়ে মরে গেল, বাচ্চা ছেলে মরে গেল, এগুলো মনে কষ্ট দেয়। এটাতে আমরা মনে করি না যে ভারতের সরকার ইচ্ছে করে এসব করেছে। যেসব কারণে এগুলো ঘটে, আমরা যেন সেই কারণগুলো উৎখাত করতে পারি। মানুষ যাতে নিরাপদে নিজের জীবন নিয়ে চলাফেরা করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করা। কাজেই এই ধরনের খুঁটিনাটি জিনিস যখন হয়, তখন আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করি, যাতে ভবিষ্যতে সেটা আর না হয়। সেটাই চেষ্টা করা।

প্রশ্ন: বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিষয়ে আপনারা কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
ড. ইউনূস: এটা একটা আইনগত বিষয়। নিশ্চয়ই আমরা তাঁকে ফেরত চাইব। তিনি যেখানেই থাকুন না কেন। আইনগতভাবে যে সিদ্ধান্ত আছে, সেই সিদ্ধান্ত আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি।

প্রশ্ন: বর্তমানে লক্ষ করছি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে। আপনি ইতিমধ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কিন্তু একটা বিষয় হলো, ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য পাকিস্তান এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি। আপনারা কী কূটনৈতিকভাবে এ ব্যাপারে পাকিস্তানের কাছে কিছু জানাতে চান?
ড. ইউনূস: আমি নেপালের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। মালদ্বীপের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী আসেননি বলে দেখা করতে পারিনি। এটা হলো সার্কভুক্ত যত দেশ আছে, আমরা চাই যে সে দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হোক। এ জন্য সবার সঙ্গে কথা বলি, আলোচনা করি। তার মানে এই নয় যে সবকিছু পাল্টে গেছে। সার্কের একটা কাঠোমো আছে, সেই কাঠামোর মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও আমরা ফোনে কথা বলেছি। ওনাকে এখানে এসে পাইনি। উনি আগেই চলে গেছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি।

প্রশ্ন: কিন্তু ১৯৭১ সালের গণহত্যার বিষয়ে যেটা বললাম…
ড. ইউনূস: সেটা পৃথক বিষয়। সেটা পাকিস্তানের সঙ্গে কিভাবে হবে…কিন্তু সার্ক প্রতিষ্ঠিত সত্য। সেই সত্যকে আমরা মেনে…আমরা চাই যে সার্ক শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হোক। সবাই একসঙ্গে কাজ করুক। সেখানে ভারত থাক, পাকিস্তান থাক। যত দেশ আছি, সবাই সমানভাবে থাকি। আমরা চাচ্ছিলাম তেমন সুযোগ যদি আসে, আমরা সার্কভুক্ত সরকারপ্রধানেরা একসঙ্গে একটা ছবি তুললাম। এটাও একটা সুন্দর বার্তা সবার কাছে যেত। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। হয়তো ভবিষ্যতে যাতে সম্ভব হয়, সে চেষ্টা আমি করে যাব।

প্রশ্ন: ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর হিসেবে যেটা পরিচিত ছিল, সেই জাদুঘর ৫ আগস্টের পর বিনষ্ট করা হলো। ১৫ আগস্টে সরকারি যে ছুটি ছিল, সেটাও আপনার সরকার বাতিল করেছে। বঙ্গবন্ধুর বহু ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে। এ নিয়ে বেশ খানিকটা সমালোচনাও হচ্ছে। আবার অনেকেই বলছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁরা ফ্যাসিবাদের আইকন হিসেবে দেখছেন। তাঁরা বলছেন, এ কারণেই এটা ঘটেছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের জাতির জনক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বীকৃত। এ ব্যাপারে আপনার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কী?
ড. ইউনূস: আপনি পুরানো দিনের কথাবার্তা বলছিলেন। এর মধ্যে একটি গণ–অভ্যুত্থান ঘটে গেছে, এটা বোধ হয় আপনার স্মরণে নেই। আপনি এমনভাবে কথা বলছেন যেন এসব ঘটনা ঘটেইনি। কাজেই নতুন ভঙ্গিতে যা হচ্ছে, সেটাকে দেখতে হবে তো। কত ছেলে প্রাণ দিল, সেটা নিয়ে আপনার প্রশ্ন নেই। কেন প্রাণ দিল। সেগুলো আসুক। কাজেই প্রথমে স্বীকার করতে হবে যে, ছাত্ররা বলেছে, আমরা রিসেট বাটন পুশ করেছি। এভরিথিং ইজ গন। অতীত নিশ্চিতভাবে চলে গেছে। এখন নতুন ভঙ্গিতে আমরা গড়ে তুলব। দেশের মানুষও তা চায়। নতুন ভঙ্গিতে চলার জন্য যেটা আছে, সেটা আমাদের সংস্কার করতে হবে।

প্রশ্ন: শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় যাঁরা হতাহত হয়েছিলেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেই বলছি, তাঁদের ঘাতকদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার কথা আপনি বলেছেন। এবং সেটা অত্যন্ত প্রশংসনীয় ব্যাপার। কিন্তু পাশাপাশি ৫ আগস্টের পরও অনেকে নিহত হয়েছেন, বিশেষ করে পুলিশ সদস্যরা। তো এই যে পুলিশদের হত্যা করা হলো কিংবা কিছু লোক নিহত হলেন, সেসব ঘটনার তদন্ত ও বিচার সম্পর্কে আপনার সরকার কী ভাবছে?
ড. ইউনূস: যে যেখানে অপরাধ করেছে তার বিচার হবে। তা না হলে তো বিচার সম্পূর্ণ হলো না। আপনি একধরনের বিচার করবেন, আরেক ধরনের বিচার করবেন, সেটার বিরুদ্ধেই তো গণ–অভ্যুত্থান হলো। যে আপনি বিচার ঠিকমতো করছেন না। একপক্ষীয় বিচার করছেন। সেটাতেই যদি আমরা ফিরে যাই তাহলে তো আর এই গণ–অভ্যুত্থানের কোনো মানে হলো না। কাজেই অপরাধ করলে অপরাধী শাস্তি পাবে এটাই হলো নীতি। অপরাধ করলেই শাস্তি পেতে হবে। আজ দুই দিন পর বা দুই বছর পরে হোক শাস্তি পাবে।

প্রশ্ন: সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাতে অন্তত চারজনের প্রাণহানির ঘটনা আমরা জানতে পারছি। আপনি কি পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা নিয়ে খানিকটা উদ্বিগ্ন?
ড. ইউনূস: সারা দেশের শান্তিশৃঙ্খলা নিয়েই উদ্বিগ্ন। আপনাকে একটু আগে বললাম, দেশে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা আমাদের বড় কাজ। এটা আমরা করতে পারছিলাম না। পুলিশের সমস্যা আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজেই আমরা এখানে শান্তি রাখব, ওখানে (পাহাড়ে) অশান্তি রাখব, এটা তো হয় না। শান্তি হলে সব জায়গাতেই শান্তি হবে। কোনো কোনো জায়গায় আমরা অপারগ হয়েছি। অপারগ হওয়ার অর্থ এই নয় আমরা ইচ্ছা করেই ওটা করছিলাম, তা না। আমাদের ইচ্ছা হলো যেখানে শান্তি রক্ষা করতে হবে সেখানেই শান্তি রক্ষা করা। পার্বত্য চট্টগ্রামে যেটা হয়েছে সেখানে শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়েছে। কিন্তু সেটা তড়িৎগতিতে আবার সমাধানও হয়ে গেছে। এটা এমন নয় যে আজকেও (বিশৃঙ্খলা) চলছে। এ রকমটা যদি ঘটে, যেকোনো সময় ঘটতে পারে, ঘটলেই সরকারের দায়িত্ব হলো সেটাকে নিরসন করা, সমাধান করা। মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য নিয়ে আসা, যাতে পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে আবার। যেটা আমরা প্রথম দিকেই ডাক দিয়েছিলাম, সারা বাংলাদেশ একটা পরিবার, আমরা পরিবার হিসেবেই চলব। আমাদের মতভেদ থাকবে কিন্তু কেউ কারও শত্রু নয়।

প্রশ্ন: শুধু এখনকার কথা নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে কিন্তু বহু বছর ধরেই কমবেশি একটা অশান্ত অবস্থা বিরাজ করছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আপনার সরকারের নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা আছে?
ড. ইউনূস: আমি তো এলাম মাত্র। এত বছরের একটা সমস্যা আমরা দুই দিনে আমাদের দিয়ে সমাধান করে দেবেন, আমরা একটা সমাধান নিয়ে আসব, এটা আশা করা তো ঠিক হবে না। বহু বছরের চেষ্টায় একটা শান্তিচুক্তি হয়েছে, সেই শান্তিচুক্তিও বহাল করা যাচ্ছে না, মান্য করছে না। এখন কি আবার নতুন করে শান্তিচুক্তি করতে হবে। এটা আমাদের সরকার পেরে উঠবে না। এটা পরে নির্বাচিত সরকার যারা আসবে, তারা এগুলো করবে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে যে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে, তাদের কি আপনারা (অন্তর্বর্তী সরকার) শরণার্থীর মর্যাদা দেবেন?

প্রশ্নড. ইউনূস: এটা তো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও দিয়েছে। ইউএনএইচসিআর (জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা) সেখানে (রোহিঙ্গাদের নিয়ে) বহুদিন ধরে কাজ করছে। কাজেই শরণার্থী হিসেবেই তো তারা (রোহিঙ্গারা) আছে, তারা আমাদের দেশের নাগরিক তো নয়। তারা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতভাবেই আছে। যদি শরণার্থী না হয়, তাহলে তো ইউএনএইচসিআর তো যেতে পারত না।

প্রশ্ন: সাম্প্রতিক সময়ে আবার কিছু রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং অনুমান করা হচ্ছে আরও রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। নতুন করে যদি আরও রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তাহলে তাদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেবেন?
ড. ইউনূস: আন্তর্জাতিক আইন আছে। তারা (রোহিঙ্গারা) যদি (বাংলাদেশে) আসতে চায় আমরা আসতে দেব। আমরা তাদের গ্রহণ করব। তারপর যা যা করতে হয়, আন্তর্জাতিক কমিউনিটি (সম্প্রদায়) আছে, এটা তো আমাদের একার সমস্যা নয়। এটা সারা পৃথিবীর একটা দায়িত্ব। যখন মানুষ শরণার্থী হয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে আশ্রয় চায়, যখন তাদের জীবনে শঙ্কা দেখা দেয়, তখন আমরা দরজা বন্ধ করে দেব, এটা হতে পারে না। এটা আইনবিরোধী কাজ। কাজেই আমরা তাদের নিয়ে আসছি, তারা থাকছে এবং কী করবে সেটা নিয়ে, এই যে জাতিসংঘে এলাম, রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমাদের বহু বৈঠক হয়েছে। কী করা যায় এগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কাজেই আপনিও জানেন বহু বছর ধরেই এটা চলছে, সাত বছর ধরে তারা (রোহিঙ্গারা) এখানে আছে। তাদের ভবিষ্যৎ কী, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। শুধু তাদের ভবিষ্যৎ নয়, তাদের ছেলেমেয়েরও ভবিষ্যৎ। (রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে) বছরে গড়ে ৩২ হাজার শিশু জন্মগ্রহণ করছে। কাজেই যারা আসছিল ১২ লাখ, এর সঙ্গে (প্রতিবছরে) ৩২ হাজার বা আরও বেশি করে যোগ হচ্ছে। তারা (রোহিঙ্গারা) অনেক বাচ্চা কোলে নিয়ে এসেছিল। তাদের (সঙ্গে) শিশু ছিল, অল্প বয়সী বালক–বালিকা ছিল। সাত বছর চলে গেছে, তাদের (সেই শিশু ও বালক–বালিকারা) বয়স বেড়েছে। এদের কী করবেন? তারা এমন পরিবেশের মধ্যে আছে, নিজেদের একটা ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না। অথচ সারা দুনিয়ার সঙ্গে তারা যুক্ত। যেহেতু টেকনোলজির (প্রযুক্তি) সাহায্যে দুনিয়াতে কী ঘটছে, সব দেখছে। তারা একটা কারাগারের মধ্যে এখানে বসবাস করছে। তাদের মনে প্রশ্ন জাগবে, তাদের মনে বিদ্রোহ জাগবে, এটা তো ভালো জিনিস নয়। এই বিক্ষোভ কীভাবে ছড়িয়ে পড়বে, কার মাথায় গিয়ে পড়বে, এটা তো বোঝার উপায় নেই। কাজেই (রোহিঙ্গাদের প্রতি) সারা পৃথিবীর দৃষ্টি দিতে হবে, তারা যেন সন্তোষজনকভাবে বাল্যকাল কাটাতে পারে, একটা আশা নিয়ে আসতে পারে। সেটা যেন আমরা করতে পারি। সেই বিষয়গুলো আমরা (জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিভিন্ন বৈঠকে) আলাপ করেছি। আমরা একটা সমাধান খুঁজছি।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তন কিংবা সংশোধনের কথা বলা হচ্ছে। আপনিও একটি কমিটি (সংবিধান সংস্কার কমিশন) করেছেন। কমিটির প্রধান করেছেন। এটা কি আপনার অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে হবে? কী ধরনের পরিবর্তন বা সংশোধন আপনারা আশা করছেন?
ড. ইউনূস: এই যে বললাম, আমাদের নতুন করে সব গড়তে হবে। সবকিছু ধ্বংস করে দিয়ে গেছে আগের সরকার। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে আমাদের পুনর্জাগরণ করতে হবে। সেটার জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা (অন্তর্বর্তী সরকার) কমিশন গঠন করে দিচ্ছি। ছয়টা কমিশন করেছি। আরও নতুন কমিশন আসছে। এর মধ্যে একটা হলো সংবিধান (সংস্কার) কমিশন। সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে সারা দেশই একমত। কী বিষয়ে হবে, কীভাবে হবে, এটা নিয়ে বিতর্ক হবে। কমিশন একটা রূপরেখা দেবে। সেই রূপরেখা নিয়ে সারা দেশে একটা বিতর্কের সুযোগ করা হবে, যাতে রাজনৈতিক দলগুলো (এই বিতর্কে) অংশগ্রহণ করে। বিচার করে তারা ঠিক করবে (সংবিধান) সংশোধন তারা এখনই করে ফেলবে নাকি ভবিষ্যতে করবে। করলে কী করবে, সেটার জন্য একটা রূপরেখা দাঁড় করানোর জন্যই এই কমিশনগুলো গঠন করা হয়েছে। এটা খুব ন্যায্য জিনিস, উপকারী জিনিস। তা না হলে যে সংবিধান আমাদের আছে, এটা দিয়ে দেশ চলবে না। এটা নিয়ে দেশ চললে আবার এই ঘটনার (আওয়ামী লীগ সরকারের মতো সরকার) সৃষ্টি হবে।
প্রশ্ন: কেউ কেউ সংবিধান পরিবর্তনের কথা বলছেন, কেউ কেউ সংবিধান সংশোধনের কথা বলছেন। পরিবর্তন বা সংশোধনই হোক, এটা কীভাবে কার্যকর হবে? এটা কি রাষ্ট্রপতির কোনো অধ্যাদেশের মাধ্যমে…
ড. ইউনূস: এটা আইনগত ব্যাপার। কীভাবে হবে…আমাদের এখন কী দরকার, সেটা ঠিক করছি। কীভাবে সেটা সংশোধন করা হবে, আইনগত কী পর্যায়ে হবে, সেগুলো যখন আলোচনায় বসবে, সেখানেই তারা ঠিক করবে। আমরা যেটা করছি, কী কী দরকার সেখানে একটা ঐকমত্য সৃষ্টি করা। এখন কীভাবে করব, সেটা নিয়ে আবার একটা আলোচনা হবে। আইনসংগতভাবে কীভাবে হবে। সেগুলো এখন আমি স্পেকুলেট (ধারণা) করতে পারছি না।

প্রশ্ন: আপনি একটু আগে একটা কথা বললেন, খুব প্রয়োজনীয় কথা। ১৯৭১ আমাদের মনে রাখতেই হবে। এটা আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ব্যাপার ছিল। আপনি নিজেও বাইরে থেকে এর সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। এখন কেউ কেউ বলছেন, রাজনীতির মূলধারায় যাঁরা সেই সময় স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁরা কিংবা তাঁদের দল অথবা তাঁদের উত্তরসূরিরা চলে আসছেন।
ড. ইউনূস: আমাদের সংবিধান বলে প্রত্যেকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। প্রত্যেকের রাজনীতি করার অধিকার আছে। সে অধিকার আমার নিশ্চিত করতে হবে। এটা সংবিধানের বিধান। সেটা থেকে আমি বেরিয়ে আসতে পারি না। এখন আপনি পছন্দ করেন বা অপছন্দ করেন। অপরাধ করলে শাস্তি পাবে। বিচারব্যবস্থা আছে, বিচারব্যবস্থা সেটা করবে। আমি রাগ করে তাঁকে আমার দুশমন ভাবি, আমি তাঁকে বেঁধে ফেললাম, তাঁর অধিকার কেড়ে নিলাম। এটা রাষ্ট্র হতে দিতে পারে না। তাহলে সেই রাষ্ট্র অচল রাষ্ট্র। রাষ্ট্রকে তার নীতিমালা অনুসারে চলতে হবে।

প্রশ্ন: আপনার সামনে মূল লক্ষ্যটা কী
ড. ইউনূস: মূল লক্ষ্য হলো সংস্কার করা। একটা নির্বাচন দেওয়া। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এটাই হলো আমাদের মূল লক্ষ্য। আর কিছু না। সিম্পল (সাধারণ) জিনিস।

 

সর্বশেষ খবর