অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস

November 8, 2024 | জাতীয়, রাজনীতি

অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স তিন মাস হচ্ছে আজ। সাধারণত যে কোনো সরকারকে তিন মাস কিংবা সময়বিশেষে ১০০ দিনের একটা হানিমুন টাইম ধরা হয়, যখন পর্যালোচনার আতশ কাচ থেকে সরকারকে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে মনে হচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সে রকম কোনো স্বস্তির কাল পাননি বা পাচ্ছেন না। এর দুটি কারণ হতে পারে। প্রথমত, যে বিপ্লবী গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পনেরো বছরের, বিশেষত ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে উত্তরোত্তর কর্তৃত্ববাদী অসহিষ্ণু হয়ে ওঠা একটি সরকারের জগদ্দল পাথর সরানোর পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্র সঠিকভাবে সংস্কার করে নতুনভাবে চালুর যে সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা দ্রুততার সঙ্গে সম্পাদনের তাগাদা থেকে বহু মানুষ সরকারকে তাদের নজরদারিতে রেখেছেন এবং যার যার মতামত-পরামর্শ শোনাতে ব্যগ্র হয়ে রয়েছেন।

এ রূপান্তরের কাজে তারাও হয়তো অবদান রাখতে চান। দ্বিতীয়ত, এ দেশে আগেও রাষ্ট্র বা সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে নবযাত্রার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু সেগুলো কাজে লাগানো যায়নি। প্রধান উপদেষ্টা নিজে এটিকেই জাতির জন্য শেষ সুযোগ আখ্যায়িত করে সবাইকে এ কাজে নিজ নিজ ভূমিকা যথাযথভাবে পালনের আহ্বান জানিয়েছেন বারবার। যেভাবেই হোক ব্যাপক মানুষের মধ্যে পাছে এ সুযোগও হাতছাড়া হয়ে যায় সে দুশ্চিন্তা রয়েছে এবং তারা এ থেকেও সরকারকে একটু দম নিয়ে পরিস্থিতি ও দায়িত্ব বুঝে কাজ করার সময় দিতে চাইছেন না। তাদের দোষ দেওয়া যাবে না, কারণ এ দেশে নানা ক্ষুদ্র স্বার্থ হাসিল করে সুযোগ ভণ্ডুল করে দেওয়ার মানুষের অভাব নেই। এটা তাদের সঙ্গত দুশ্চিন্তা তাতে সন্দেহ নেই।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বের দুটি প্রধান ক্ষেত্র চিহ্নিত করা যায়। তাদের প্রথম কাজ, যেভাবেই বলি না কেন, অবশ্যই রাষ্ট্র সংস্কার বা মেরামত। আর দ্বিতীয় কাজ হলো দেশের নৈমিত্তিক দায়িত্ব তথা নিয়মিত প্রশাসনিক কাজকর্ম সম্পাদন। দুটি ক্ষেত্রের কাজের গুণগত পার্থক্য মেনেও বলতে হবে দুটিই অত্যন্ত গুরুত্বপূূর্ণ, জটিল এবং শ্রমসাধ্য কাজ। আবার যে কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকাও সম্ভব নয়। বর্তমানে তা আরও অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। কারণ গণ-অভ্যুত্থানের যে আকাক্সক্ষা ও ধরন ছিল, পরবর্তী সময়ে গঠিত সরকার সে পদ্ধতিতে হয়নি। নাম পাল্টালেও এটি যে কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি সরকার। পরিস্থিতির কারণে এ সরকারের সাংবিধানিক ভিত্তি খানিকটা অস্বচ্ছ এবং দুর্বল বা বলা যায় এ নিয়ে নানাভাবে প্রশ্ন তোলা যায়। প্রশ্ন যে উঠছে না তা-ও নয়। বিষয়টা সম্ভবত উপদেষ্টামণ্ডলীও বোঝেন এবং প্রধান উপদেষ্টা সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে (গত ৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত) নিজেই সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিলেন তার সরকারের মেয়াদ কতদিন হওয়া উচিত। সেখানে নানাজনের নানান মত থাকলেও মোটামুটি দেড় থেকে দুবছরের ধারণাই প্রধান ছিল। দেখা যাচ্ছে গণ-অভ্যুত্থানের চিন্তক-সংগঠকদের মধ্যে ভিন্ন চিন্তাও আছে। তাদের অনেকের হয়তো এখন উপলব্ধি হলো যে, বিপ্লব হয়েও সরকার গঠনের প্রক্রিয়ার কারণে তা অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। দেরিতে হলেও এটি সংশোধনের পথ তাদের কেউ কেউ দেখাচ্ছেন। তবে দূর থেকে মনে হয় ছাত্র ও জনগণকে তিন মাসের ব্যবধানে আবার জুলাই-আগস্টের একই বিপ্লবী মাত্রায় রাজপথে নামানো সহজ হবে না। তা ছাড়া বিগত সরকারের বিদায় এবং বর্তমান সরকারের অভ্যুদয়ের পেছনে সামরিক কর্তৃপক্ষেরÑ একটির শেষ পর্যায়ে ও অপরটির সূচনা পর্বেÑ প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। এখনকার সরকার কাঠামোয় তাদের অবস্থান যথেষ্ট শক্তিশালী বলেই মনে হয়। তা ছাড়াও মনে রাখতে হবে মাঠের রাজনৈতিক শক্তিসমূহের ভূমিকার কথা। অনেক দলই বিগত সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও শক্তির দিক থেকে এবং দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম ও মামলা-হামলার চাপ সামলানোর বিবেচনায় তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবে। জামায়াতও এ পরিস্থিতিতে একটা ভালো অবস্থানে পৌঁছেছে। বিএনপি যে দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে তা নিয়ে তারা রাখঢাক করছে না। জামায়াত এ বিষয়ে এ পর্যায়ে কিছুটা নমনীয় থাকলেও একটি রাজনৈতিক দলের স্বাভাবিক অভীষ্ট হিসেবে নির্বাচন তাদেরও বিবেচনায় যে রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। যে কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য এটাই স্বাভাবিক চিন্তা। ফলে এতসব অংশীজনের আকাক্সক্ষাকেও উপেক্ষা করা যাবে না।

আমাদের মনে হয় অন্তর্বর্তী সরকার তাদের গঠিত সংস্কার কমিটিগুলোর প্রতিবেদনকে কোনো পদ্ধতিতে যাচাই-বাছাই করে একটি চূড়ান্ত রূপ দিতে পারে। এর জন্য রাজনৈতিক দলের মতামত গ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তা ছাড়া পেশাজীবী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ ও অ্যাকাডেমিশিয়ান এবং সরকার মনে করলে, উল্লিখিত বর্গের বাইরের বিশিষ্টজনের মতামতও নিতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রেও সব সংস্কার কমিটির প্রতিবেদন (পরামর্শ) চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার বিশাল কর্মযজ্ঞ যৌক্তিক সময়ের মধ্যে পালন সম্ভব হবে কিনা তা ভাবতে হবে। মনে হয় অন্তর্বর্তী সরকারের যে মূল কাজ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন সে লক্ষ্য মাথায় রেখে এ সংক্রান্ত কমিশনের কাছ থেকে একটি বিস্তারিত চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়াই জরুরি। এটাতে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র, সরকারের মেয়াদ, স্থানীয় সরকারের স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়নের মতো নতুন ও মৌলিক সব বিষয় থাকবে। সরকার এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব রাজনৈতিক দলের মতামত গ্রহণ করে তাদের সম্মতিতে খসড়া চূড়ান্ত করবেন। বলা বাহুল্য, নির্বাচন ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে সমাধান ও আইনের শাসনের নানা বিষয় আসবে যা সংশ্লিষ্ট কমিশন তাদের প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করবেন। তবে সঙ্গতকারণেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকার সব বিষয়ে স্থায়ী সমাধান দিতে পারেন না। রাজনৈতিক দলও তাতে সম্মত হবে না, কারণ গণতন্ত্রে জনমত, সময়ের চাহিদা, পরিস্থিতির দাবি ইত্যাদি বিষয়ের বিবেচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা পূরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ থাকতেই হবে। আগামী বছর শেষ নাগাদ জাতীয় নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে এখন থেকেই সংস্কার কাজের আওতা, পরিধি এবং তা সম্পন্ন করার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করাই ভালো হবে।

সরকারের যে নৈমিত্তিক দায়িত্বের কথা প্রথমে বলেছি তা একাই যে কোনো সরকারের জন্য হিমশিম খাওয়ার মতো বিষয়। চাহিদা ও সাধ্যের টানাপড়েনে ব্যতিব্যস্ত বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখা ও মূল্য নিযন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। তদুপরি জাতি হিসেবে আমরা কোনো বড় ইস্যুতেÑ যেমন বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন ঘটানোÑ বিপুলভাবে সাড়া দিলেও সেই ঐক্য, সেই স্পিরিট একই মাত্রায় দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ঐক্য ছিল তা স্বাধীনতার পরে ধরে রাখা যায়নি। প্রায়ই ঘটনার নানা অনুষঙ্গ নিয়ে কুশীলবদের সম্পর্কে নানা কথা ছড়াতে থাকে যা ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচকই বেশি হয় এবং ফলে জনমনের অঙ্গীকারের পাটাতন দুর্বল হয় ও ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা-অস্থিরতায় ভুগতে থাকে তারা সবাই।

সর্বোপরি মনে রাখতে হবে গণতন্ত্র যেমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা, তেমনি এটি একটি সংস্কৃতিও বটে। এই সংস্কৃতির বিকাশ ছাড়া সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ নির্মাণ সম্ভব নয়। আর গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছাড়া শক্তিশালী গণতন্ত্র সচল রাখা যায় না। আমাদের কাজ হলো একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের পথে দৃঢ় পদক্ষেপে যাত্রা শুরু করা। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এটাই জাতির প্রত্যাশা বলে মনে করি। তাদের দেখাতে হবে যাত্রাপথে যেন কোনো অন্তরায় বা বাধা সৃষ্টি না হয়। কেননা তাতে এযাবতের অর্জন ব্যর্থ হয়ে যায়। অব্যাহত গণতান্ত্রিক যাত্রার মাধ্যমেই কোনো দেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি মজবুত হয় এবং দিনে দিনে একটি পদ্ধতি হিসেবে তা সফলতা অর্জন করে। এটি রাতারাতি অর্জনের বিষয় নয়।

আবুল মোমেন : কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক, দৈনিক আমাদের সময়

সর্বশেষ খবর